ভূমিকা : ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের মানুষের জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিবস। কেননা, এ দিবসটিতে এদেশের মানুষ এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্ব মানচিত্রে আত্মপ্রকাশ করেছে। আর এর মূলে রয়েছে বহু ত্যাগ তিতিক্ষা, সাধনা ও সংগ্রামের কাহিনী।
রাষ্ট্রভাষা ও স্বাধীনতা : ভাষা আন্দোলনের প্রশ্নেই বাংলার মানুষের মধ্যে ঘটে আত্মােপলব্ধি। রাষ্ট্রভাষার এ প্রশ্নে ৫২-র ২১শে ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার রাজপথ তরুণ ছাত্রদের রক্তে রাঙ্গা হয়ে ওঠে। ভাষার প্রশ্নেই রাজপথে জাতীয়তাবাদের স্ফুরণ ঘটে। আর বাংলা ভাষা নিয়ে আন্দোলন শেষ অবধি রূপ নেয় গণঅভ্যূত্থানে। ৭১ এর ৭ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক ভাষণ দিলেন, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।" বসতত এই ঘােষণার পর থেকে পূর্ব বাংলায় মুক্তি সংগ্রাম শুরু হয়, যার শেষ পরিণতি স্বাধীন বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ।
১৯৭১ এর ঘটনা : ঘনিয়ে আসে ২৫ মার্চের ভয়াল কালাে রাত। শুরু হয়ে গেল হানাদার বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ ও ববরতা। নৃশংসতায় যা তৈমুর, চেক্গিশ, নাদির, হালাকু খাঁকেও হার মানায়। হানাদার বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসগুলােতে, পুলিশের ছাউনিতে, অধ্যাপকদের আবাসে আর নিঝুম বস্তিতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসে, পথে প্রান্তরে পড়ে থাকে কত অসংখ্য মানুষের লাশ। ঢাকা নগরী এক মৃত্যুপুরীতে পর্যবসিত হয়।
আর এই মরণযজ্ঞের মধ্য দিয়ে মুক্তিকামী বাঙালি গড়ে তােলে প্রতিরােধ আন্দোলন মুক্তি সংগ্রাম।
মুক্তিযুদ্ধ : প্রায় ৭ কোটি নির্যাতিত মানুষের স্বাধীনতার চেতনাই এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে পরিণত হয়। আর এ সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধ নামে সুপরিচিত। মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক ছিলেন জেনারেল ওসমানী। মুক্তিযুদ্ধকালে বিভিন্ন সেক্টরের দায়িত্বে ছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর খালেদ মােশাররফ, মেজর শফিউল্লাহ, মেজর মীর শওকত আলী, মেজর সি. আর দত্ত, মেজর মঞ্জুর প্রমুখ মুক্তিবাহিনীর সংখ্যা প্রায় লাখের নিকট গিয়ে দাঁড়ায়।
স্বাধীনতা অর্জন : শেষ অবধি ভারত এ যুদ্ধে জড়িত হয়ে পড়ে। ডিসেম্বর মাসের প্রথম দিকে পাক-হানাদার বাহিনীর অধিনায়ক লে: জেনারেল নিয়াজী পূর্ব পাকিস্তানের রণাজ্গনে (বাংলাদেশ-ভারত) যৌথ কমান্ডের অধিনায়ক লে: জেনারেল অরােরার নিকট আনুষ্ঠানিকভাবে ১৬ ডিসেম্বর আত্মসম্পর্ণ করে।
ত্রিশ লাখ মানুষের রক্তের বিনিময়ে নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত হয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌম বাংলাদেশ। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ এ ঘটে বাংলাদেশের মানুষের পরিপূর্ণ বিজয়। বাংলার মানুষ অর্জন করে একটি পতাকা যে পতাকায় সবুজের মধ্যে সূর্যের
আলাে জ্বল জ্বল করছে। বিশ্বের মানচিত্রে প্রতিষ্ঠিত হলাে নতুন একটি রাষ্ট্র যে রাষ্ট্রের নাম 'বাংলাদেশ'।
উপসংহার : বাংলা ভাষাকে ভিত্তি করেই বাংলাদেশে স্বাধীনতা আন্দোলনের সূচনা। আর এ আন্দোলন রূপ নেয় রক্তক্ষয়ী এক মুক্তিযুদ্ধে। নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে এক সাগর রক্ত পেরিয়ে যে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে সেই বাংলাদেশ সকল বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে এ বিশ্ব দরবারে সগৌরবে মাথা উচু করবে। মুক্তিযুদ্ধ অনাগত কাল ধরে বাংলাদেশের সকল মানুষের কাছে এক উজ্জ্বল আদর্শ ও প্রেরণা হয়ে থাকবে। মুক্তিযুদ্ধ হবে আমাদের জীবন ও কর্মের প্রেরণাস্বরূপ।