স্থানকাল যে গতিশীল হতে পারে এ সম্পর্কে প্রথম ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন রূশ বিজ্ঞানী আলেকজান্ডার ফ্রিডম্যান। তার ব্যাখ্যা ছিল মূলত: দুটি অনুমানের উপর।
এই অনুমান দুটি হল-
(১) আমরা যে দিকেই তাকাই মহাবিশ্বের রূপ একই রকম দেখায় এবং
(২) আমরা যদি মহাবিশ্বকে অন্য কোন স্থান থেকেও পর্যবেক্ষণ করি তাহলেও মহাবিশ্বকে একই রকম দেখাবে। শুধু এই দুটি মাত্র অনুমান থেকে ফ্রিডম্যান আইনস্টাইনের মূল সমীকরণের সমাধান থেকে এই সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে, মহাবিশ্ব স্থির হতে পারে না। পরবর্তীতে আমেরিকান পদার্থবিজ্ঞানী হাওয়ার্ড রবার্টসন এবং ব্রিটিশ গণিতবিদ আর্থার ওয়াকার মহাবিশ্বের সম্প্রসারণশীল প্রতিরূপ আবিষ্কার করে প্রকৃতপক্ষে ফ্রিডম্যান প্রতিরূপই সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। অসীম স্থির মহাবিশ্ব সম্পর্কে আরেকটি আপত্তি আসে অলবার্সের সমস্যা থেকে। সমস্যাটি আসলে প্রথম তুলে ধরেছিলেন চেসিউ (Cheseaux) ফরাসি বিপ্লবের সময়। তারপর আরাে অনেকেই সমস্যাটির কথা বলেছেন। কিন্তু সমস্যাটি প্রথম জনসমক্ষে নিয়ে আসেন জার্মান দার্শনিক হাইনরিখ অলবার্স ১৮২৩ সালে।
সমস্যাটি হল, রাতের আকাশ অন্ধকার কেন? প্রশ্নটা শুনে আপনি হয়তাে ভাববেন। এটা আবার একটা প্রশ্ন হল না কি? রাতের বেলা আকাশে সূর্য থাকে না। তাই রাতের আকাশ অন্ধকার। কিন্তু সূর্য না থাক, রাতের আকাশে নক্ষত্ররাতে থাকে। নক্ষত্ররা অনেক দূরের হলেও তাদের সংখ্যা তাে অসীম। সুতরাং রাতের আকাশ উজ্জ্বল হবে না কেন? এ সমস্যাটি নিয়েই যুক্তিপূর্ণ আলােচনা করেছেন অলবার্স।
তিনি কয়েকটি অনুমানের ভিত্তিতে বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর অনুমানগুলাে হলঃ
১, মহাবিশ্ব অসীম এবং স্থির। স্থানকালের জ্যামিতি ইউক্লিডীয়।
২. নক্ষত্ররা স্থানকালে এমন সুষমভাবে বিতরিত যে-কোন দৃষ্টিরেখায় একটা না একটা নক্ষত্র পাওয়া যাবেই।
৩, প্রত্যেক নক্ষত্রের শক্তি উদগীরণ ক্ষমতা একই।
৪, মহাবিশ্ব অনন্তকাল ধরে আছে।
৫, আন্তঃনাক্ষত্রিক জগৎ ফাঁকা। সেখানে আলাে শােষণকারী কোন মাধ্যম নেই।
এই অনুমানগুলাের ভিত্তিতে এবং নক্ষত্রদের বিন্দুবস্তু বিবেচনা করে তিনি প্রথমে রাতের আকাশের যে উজ্জ্বলতা নির্ণয় করলেন দেখা গেল তার পরিমাণ প্রায় অসীম। কিন্তু নক্ষত্ররা বিন্দু বস্তু নয়। তাদের বিস্তৃতি আছে। কাজেই কাছের নক্ষত্ররা দূরের নক্ষত্রদের আলাে অনেকটাই আড়াল করে রাখতে পারে। এই বিষয়টি বিবেচনায় এনে তিনি পুনরায় হিসেব-নিকেশ করে দেখলেন যে নক্ষত্ররা যদি সকলেই সূর্যের সমতুল্য হয় তাহলে রাতের বেলায় ভূ-পৃষ্ঠের উজ্জ্বলতা হবে সৌরপৃষ্ঠের উজ্জ্বলতার সমান। অর্থাৎ ভূ-পৃষ্ঠের রাতের তাপমাত্রা হবে প্রায় ছয় হাজার ডিগ্রী কেলভিনের মত। অথচ বাস্তবে আমরা পাই ভিন্ন চিত্র। রাতের আকাশ অন্ধকার এবং অপেক্ষাকৃত ঠান্ডা।
এখানেই স্ববিরােধীতা। এই জন্যই এই সমস্যাটিকে ‘অলবার্স প্যারাডক্স' হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। অলবার্সের পরে অনেক বিজ্ঞানী রাতের আকাশকে অন্ধকার করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সফলকাম হন নি। কেননা আলবার্সের গণনায় কোন ভুল ছিল না। তাই বিজ্ঞানীরা ভেবেছিলেন, আলবার্সের গণনায় যদি কোন গলদ থেকে থাকে তাহলে তা তাঁর অনুমানগুলাের মধ্যেই থাকবে। এর মধ্যে দ্বিতীয় এবং তৃতীয় অনুমান নিয়ে কোন সমস্যা নেই। এ অনুমান দুটো সাধারণভাবে গ্রহণীয়। বাকিদের মধ্যে পঞ্চম অনুমানটি বিশেষভাবে লক্ষণীয় যেখানে আন্তনাক্ষত্রিক জগৎকে শূন্য বিবেচনা করা হয়েছে। কিন্তু আসলে এ জগৎ ফাকা নয়। এখানে শক্তি শােষণকারী এক মাধ্যমের উপস্থিতি রয়েছে।
কাজেই দূর নক্ষত্র থেকে আগত আলাের অনেকটাই এই মাধ্যম শােষণ করে নিবে। ফলে পৃথিবীতে যে আলাে এসে পৌছবে আশা করা যায় তা হবে ক্ষীণ। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা হয় না। কেননা মাধ্যম' শক্তি শােষণ করে নিজেই উত্তপ্ত হতে থাকবে এবং পরে সে নিজেই বিকিরণ শুরু করবে। ফলে রাতের আকাশের উজ্জ্বলতার খুব একটা হেরফের হবে না। প্রথম ও চতুর্থ অনুমানে মহাবিশ্ব স্থানে' ও কালে' অসীম এবং স্থির । কিন্তু বিশ্ব স্থানে অসীম হলেও যদি কালে সসীম হয় তাহলে এতদিনে মহাবিশ্বের সমস্ত নক্ষত্রের আলাে নিশ্চয়ই পৃথিবীতে এসে পৌঁছতে পারে নি। কেননা আলাের গতিবেগ সীমিত। তাই পৃথিবীতে আমরা এখন পর্যন্ত সীমিত সংখ্যক নক্ষত্রের আলাে পেয়ে থাকব। সেক্ষেত্রে রাতের আকাশের উজ্জ্বলতাও হবে সীমিত। আবার মহাবিশ্ব যদি স্থানেও সসীম হয় তাহলেও নক্ষত্রদের সংখ্যা হবে সীমিত। সেক্ষেত্রেও আমরা সীমিত আলাে পাব।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে মহাবিশ্ব যদি স্থানে ও কালে সসীম হয় তাহলে রাতের আকাশের উজ্জ্বলতা হ্রাস পাবে। কিন্তু প্রশ্ন হল, কতটা'। তাছাড়া তৎকালে স্থান ও কালের সসীমতার ধারণা ছিল অনেকটা কৃত্রিম। এর কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি ছিল না। অন্যদিকে মহাবিশ্ব স্থির না হয়ে গতিশীল হলে রাতের উজ্জ্বলতার উপর তার কি প্রভাব পড়বে সে সম্পর্কে তখন কোনরূপ ধারণাই ছিল না। তাই দেখা যায় অসীম স্থির বিশ্বের ধারণা থেকে অলবার্সের সমস্যার কোন সমাধান সম্ভব হয়নি।