চারটি মৌলিক বলের মধ্যে সবচেয়ে দুর্বল বল হল মহাকর্ষীয় বল । এই বল দুর্বল হলেও এর পাল্লা কিন্তু অসীম। কণাবাদী তত্ত্ব অনুসারে 'গ্রাভিটন” নামক ২ চক্ৰণ বিশিষ্ট এক প্রকার কণা এই বল বহন করে। প্রাভিটন ভরহীন। তাই অসীম দূরত্বেও এই বল ক্রিয়াশীল। মহাকর্ষীয় বলের বিশেষত্ব হল এই যে, এই বল সব সময়ই আকর্ষণ করে। তবে গ্রাভিটন কিন্তু এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি। গ্রাভিটন আবিষ্কারের একমাত্র সম্ভাব্য ক্ষেত্র হল মহাকর্ষীয় বিকিরণ ।
একটি মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র যখন ক্রমাগত পরিবর্তিত হতে থাকে তখন মহাকর্ষীয় বিকিরণের সৃষ্টি হয়। এই বিকিরণের কোয়ান্টাম হল গ্রভিটন। কিন্তু এই বিকিরণ এতই দুর্বল যে বিকিরণের তরঙ্গগুলােকে সনাক্ত করা বড়ই কঠিন। খুব দ্রুত পরিবর্তনশীল মহাকর্ষীয় বলের ক্ষেত্রে এই তরঙ্গ সনাক্ত করা সহজসাধ্য হতে পারে। সাম্প্রতিক কালের যুগল পালসারের আবিস্কার মহাকর্ষীয় তরঙ্গ সনাক্ত করার পক্ষে একটি প্রধান মাইল ফলক । দ্বিতীয় প্রকার মৌলিক বল হল বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বল । এই বলের বৈশিষ্ট্য হল এরা আকর্ষণ করে, বিকর্ষণও করে।
একই ধরনের আধানের দুটি কণা কিংবা একই ধরনের পােলের দুটি চুম্বক পরস্পরকে বিকর্ষণ করে। কিন্তু বিপরীত আধানের কণা অথবা বিপরীত পােলের চুম্বক পরস্পরকে আকর্ষণ করে। আপাতদৃষ্টিতে বৈদ্যুতিক বল এবং চুম্বকীয় বল আলাদা বলে মনে হয়। কিন্তু ম্যাক্সওয়েল দেখিয়েছেন যে এই দুটি বল একই বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বলের আলাদা প্রকাশ । বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বল ১ চক্ৰণবিশিষ্ট ‘ফোটন' নামক কণাদ্বারা বাহিত। ফোটন ভরহীন । সুতরাং এই বলের পাল্লাও অসীম। তবে বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বলে যে সব ফোটনের বিনিময় হয় তারা কল্পিত কণা।
কিন্তু বােরের পারমাণবিক নক্সায় একটি ইলেকট্রন যখন কোন অনুমােদিত কক্ষ থেকে অন্য কক্ষে ঝাপ দেয় তখন যে ফোটন নির্গত হয় তা বাস্তব কণা'। মহাকর্ষীয় বল এবং বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বল ছাড়া বাকি দুটি বল হল কেন্দ্রীয় বল । একটি সবল বল এবং অন্যটি ক্ষীণ বল। এই দুটি বলই স্বল্প পাল্লার । পরমাণুর কেন্দ্রে এই বল ক্রিয়াশীল । ক্ষীণ বল , চক্ৰণবিশিষ্ট সকল প্রকার কণার উপর কাজ করে। আগে মনে করা হত নিউট্রন একটি স্থায়ী কণা। কিন্তু দেখা যায় নিউট্রন কেন্দ্রীনের মধ্যেই স্থায়ীভাবে থাকতে পারে।
কেন্দ্রীনের বাইরে এলেই নিউট্রন স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভেঙে যায়। একটি নিউট্রিন নির্গত করে পরিণত হয় একটি ইলেকট্রন ও একটি প্রােটনে। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় বিটা-ভাঙা প্রক্রিয়া। কোন কোন কেন্দ্ৰীনের ভেতরেও এই বিটা-ভাঙা প্রক্রিয়া লক্ষ্য করা যায়। প্রাথমিকভাবে কেন্দ্রীনের বিটা-ভাঙা প্রক্রিয়াই ক্ষীণ বল নামে পরিচিত ছিল। সব ধরনের তেজস্ক্রিয়তার (radioactivity) কারণ এই ক্ষীণ বল । ১৯৬৮ সালের আগে পর্যন্ত ক্ষীণ বল সম্বন্ধে খুব একটা স্পষ্ট ধারণা ছিল না। এই সময় ইম্পেরীয়াল কলেজের আব্দুস সালাম এবং হার্ভার্ডের স্টিফেন উইনবার্গ একটি তত্ত্ব উপস্থাপন করেন। তাতে তারা বলেন, বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বল যেমন ফোটন দ্বারা বাহিত হয় দুর্বল বলও তেমনি তিনটি কণা দ্বারা বাহিত হয়।
এই তিনটি কণা হল। ডব্লিউ প্লাস (w), ডব্লিউ মাইনাস (W), এবং জেড নট (Z0)। এই তিনটি কণাই ফোটনের মত ১ চক্ৰণ বিশিষ্ট। কিন্তু এদের ভর অত্যন্ত বেশি। সেই কারণে এই বলের পাল্লা খুবই কম । w+ এবং W” এর ভর প্রায় ৮০ Gev এবং z0-এর ভর প্রায় ৯০ Gev । এখানে স্বভাবতঃই একটি প্রশ্ন দেখা দেয়। বলা হয়েছে নিউট্রনের বিটাক্ষয়ের কারণ হল নিউট্রন থেকে W® কণার নির্গমন। কিন্তু w® এর ভর নিউট্রনের থেকে প্রায় ৮০ গুণ বেশি। সে ক্ষেত্রে নিউট্রন থেকে এই কণা নির্গত হয় কিভাবে? আসলে এর উত্তর খুব সহজে বােধগম্য নয়। এক অর্থে এই কণাটি 'অবাস্তব' এবং ক্ষণস্থায়ী যার কারণে অনিশ্চয়তা সূত্র থেকে সে কিছু শক্তি ধার করতে পারে যে শক্তি আবার ভরে পরিণত হয় ।
সালাম-উইনবার্গ তত্ত্বের মূল বক্তব্য হল, স্বল্প শক্তিতে যে সকল কণা ভিন্নভাবে আচরণ করে উচ্চশক্তিতে তাদের অনেকেরই আচরণ সমরূপ হয় । তাই তাঁরা বলেন, অল্প শক্তিতে বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বলবাহী কণা ফোটন' এবং ক্ষীণ বলবাহী কণা w+, w® এবং 70 আলাদা বলে প্রতিভাত হলেও ১০০ Gev শক্তিতে তাদের আচরণ হবে সমরূপ । অর্থাৎ ১০০ Gev শক্তিতে বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বল এবং ক্ষীণবল অভিন্ন। এভাবে W এবং Z কণা আবিষ্কারের মাধ্যমে সালাম এবং উইনবার্গ প্রকৃতপক্ষে বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বল এবং ক্ষীণবলকে ঐক্যবদ্ধ করেছেন। হার্ভার্ডের শেলডন গ্রাশােও একই তত্ত্ব উপস্থাপন করছিলেন।
কিন্তু তখনকার দিনে কণিকা ত্বরণ যন্ত্রগুলাের ১০০ Gev শক্তিতে পৌছানর ক্ষমতা ছিল না। তাই এই তত্ত্ব তখন সরাসরি প্রমাণ করা সম্ভব হয়নি। তবে অল্প শক্তিতে প্রস্তাবিত কণিকাসমূহের আচরণজনিত পূর্বাভাস পরীক্ষামূলক তথ্যের সংগে চমৎকার ভাবে মিলে যায় । এজন্য ১৯৭৯ সালে সালাম, উইনবার্গ এবং গ্রাশাে এই তিনজনকেই নােবেল পুরস্কার দেয়া হয়। চতুর্থ শ্রেণীর বল হল সৰল কেন্দ্রীয় বল। এই বলই কেন্দ্রীনের কণাগুলােকে এক সংগে বেঁধে রাখে । আগেই উল্লেখ করেছি এই বলের আবিষ্কর্তা জাপানী বিজ্ঞানী য়ুকাওয়া ।